ভারতের মুসলিম নাগরিক হয়ে যদি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় সশরীরে গিয়ে দেখতে না পারি তাহলে সেটা আলিগড় তো বটেই স্যার সৈয়দ আহমদের সঙ্গেও অবিচার হবে। সেই অনুতাপ থেকেই মনস্থির করলাম একবার যেতেই হবে আলিগড়, স্বচক্ষে দেখতে হবে মুসলিম মনীষার অন্যতম এই পীঠস্থানটিকে।
তারিখ ১৭ নভেম্বর ২০২০। লকডাউন সবে উঠেছে, করোনা ভাইরাসও ওয়ান ডে, টি টুয়েন্টি সেরে সবে টেস্ট ম্যাচে পা দিয়েছে। এর মধ্যেই ঝুঁকিটা নিয়ে নিলাম। কুম্ভীরগ্রাম বিমান বন্দর থেকে এয়ার বাসে চেপে সোজা দিল্লি এয়ারপোর্ট।
অসুবিধার কোনো কারণ ছিল না। কেননা, আগে থেকেই ওখানে ছিল আমার প্রাণ প্রিয় ছাত্র বর্তমানে আলিগড় ইউনিভার্সিটির ছাত্র ফিরদাউস আহমেদ বড়ভুঁইয়া। সে বদরপুর আল আমিন একাডেমির প্রাক্তন ছাত্র। নিজে আল আমিনের জন্মলগ্ন থেকে জড়িত আছি।সেই সুবাদে ফিরদাউসকে ভালো করে জানি। ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে কেমন যেন একটা নাড়ির সম্পর্ক হয়ে যায়। কোনো সময় একা বসলে ওদের খুব মনে পড়ে। নস্টালজিক হয়ে পড়ি। তাই ভাবলাম আলিগড় দেখতে গেলে ওদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে।
যাইহোক, রাত প্রায় বারোটায় গিয়ে পৌঁছলাম দিল্লি এয়ারপোর্ট। ওখানেই ফিরদাউসের ফোন পেলাম। ফোন করে সে আমার লোকেশনটা জেনে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে সে উপস্থিত। আমার হাত থেকে হালকা ওজনের ব্যাগটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে সবিনয়ে বলল, স্যার উঠে পড়ুন। গাড়ির দরজা খুলে দিল সে।
গাড়িতে উঠে নানা বিষয় নিয়ে গল্প শুরু হলো। প্রায় ১৪৯ কিমি রাস্তা কীভাবে যে শেষ হয়ে গেল টেরই পেলামনা।
গাড়ি গিয়ে থামল একটি হোটেলের সামনে।আমি অবাক হলাম ফিরদাউসের আতিথেয়তা দেখে। আগে থেকেই সে আমার জন্য হোটেলের কামরা বুক করে রেখেছে। রুমে নিয়ে গিয়ে সে আমাকে বিশ্রাম নিতে বলল।সঙ্গে জানিয়ে রাখল সকাল ৭ টায় সে আমাকে নিতে আসবে।
কথা মতো সকাল ৭ টায় ফিরদাউস বাইক নিয়ে হাজির। বাইকে চেপে পৌঁছলাম স্বপ্নের ইউনিভার্সিটিতে। এক মূহুর্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে স্যার সৈয়দ আহমদকে মনে করার চেষ্টা করলাম। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়টা ছিল ব্রিটিশ ভারতের মুসলমানদের জন্য কঠিন একটা সময়। সিপাহি বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর মুসলমানরাই ছিল অত্যাচারের মূল উপাদান। শিক্ষা, অর্থনীতিতে মেরুদণ্ডরহিত একটা জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল মুসলমানরা। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন স্যার সৈয়দ। এতে অনেকরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মিশন ছিল আধুনিক শিক্ষা দীক্ষায় কীভাবে এই জাতিটিকে উন্নত করা যায়, কীভাবে এই জাতিটিকে মূলধারার রাজনীতিতে নিয়ে আসা যায়। এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে ১৮৭৫ সালে কেমব্রিজের ধাঁচে প্রতিষ্ঠা করেন মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ। যার পরবর্তী পূর্ণাঙ্গ রূপ আজকের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। এর মধ্যে মুসলিম নাম পরিবর্তনের জন্য একটা চক্র কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি।তবে, আর যাই হোক উদ্দেশ্যে পূরণে আমু অনেক সফল হতে সক্ষম হয়েছে। এখন পর্যন্ত অনেক রাজনীতিবিদের জন্ম দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার ফিজিক্যাল লাইব্রেরি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি। আজ ১১৫৫ একর জমির ওপর গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখবো। একটা অজানা গর্বে বুকটা ফুলে উঠল। একটা লম্বা গর্বের নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আজমলের মুসলিম সম্ভাষণে আমার ইতিহাসের ঘোর কাটলো। আজমল আরেক স্নেহের ছাত্র। ফিরদাউস ও আজমলকে সঙ্গে নিয়ে দেখলাম ঝাঁ চক চকে বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধান লাইব্রেরিতে ঢুকতেই নজর পড়ে গ্যালারিতে লাগানো পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিদের ছবির দিকে। একেক জনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে একেকটা ইতিহাস। বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটলে মনে হয় এখনো কোনো হলে রয়েছেন স্যার সৈয়দ আহমদ। মনে হয় গম্ভীর হয়ে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অলিন্দে পায়চারি করছেন তিনি। বুঝলাম মরে গিয়েও অমর হয়ে থাকার এটা একটা অনুভূতি।অবচেতন মনে স্যার সৈয়দ আহমদের জন্য দোয়া বেরিয়ে এল, আল্লাহ্পাক যেন তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মোকাম দান করেন।
আলিগড় ইউনিভার্সিটিতে দাঁড়িয়েই মনে হল বদরপুর আল আমিন একাডেমিকে বরাকের আলিগড় বললে কেমন হয়। পরে মনে হল ,আলবাৎ বলা যায়। এতে কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। আলিগড় যেভাবে মুসলিম শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা বিপ্লব এনেছিলো, আল-আমিন একাডেমিও তদ্রূপ বরাকে মুসলিম শিক্ষার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এবং রেখে চলেছে। স্যার সৈয়দের মতোই স্বপ্ন দেখেছিলেন হিফজুর রহমান ভাই, বিলাল আহমেদ ভাই, মবরুর আহমেদ ভাই প্রমুখ।তাঁদের প্রচেষ্টায় বদরপুরে গড়ে ওঠে আল-আমিন একাডেমি।
শুরুর দিকে খাজাম ভাই, মতিউর স্যারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ২০০৫ সালে মাধ্যমিকে আসে চমকে দেওয়ার মতো ফল। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি আল-আমিন একাডেমিকে। ক্রমে বরাক তো বটেই রাজ্যের একাডেমিক খাতায় নাম ওঠে আল-আমিনের। এইচএসএলসিতে দ্বাদশ ও বিংশ স্থান দখল করতে সক্ষম হয় আল-আমিনের পরীক্ষার্থীরা।বিলাল ভাই, ফয়জুল ভাই, সিরাজ ভাই, হিফজুর স্যারদের পরিশ্রম বৃথা যায়নি। আজ এক গর্বের নাম বদরপুর আল-আমিন একাডেমি। শুরুর দিকে অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তা এখন একটা ভুলে যাওয়া ইতিহাস।
বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতিষ্ঠাতাদের হাতকে শক্ত করতে নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ফজলুল করিম চৌধুরি, সোহরাব সহ হাবিবুর রহমান, আহমদ আলি সাহেব প্রমুখ।স্কুলকে তাঁরা এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন। জামাতে ইসলামির সাউথ আসাম জোনের আমির জনাব নুরুল ইসলাম মাঝারভূঁইয়ার বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব আগামী দিনেও এই স্কুলটি বরাক তথা আসামের এক অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।
লিখেছেন- মারুফ আহমদ সদিওল, সম্পাদক আল-আমিন চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, বদরপুর